'মৃত্যু আছে বলেই জীবনটাকে আমি এত সহজভাবে নিতে পারি। পৃথিবীতে এসেছিলাম একদম খালি হাতে, ফিরে যেতে হবে খালি হাতে, হারানোর কিছুই নেই আমাদের। তাহলে কেন মানুষের প্রত্যাশার চাপ এত বেশি থাকে! আপনার মন যা চায় সেটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটাই করুন।"- স্টিভ জবসের এই উক্তিটি আমার ভীষণ প্রিয়। তিনি নিজের জীবনে সেটি করে দেখিয়েছেন। একাডেমিক সার্টিফিকেটকে তিনি থোড়াই কেয়ার করেছেন। কিন্তু হারিয়ে যান নি। সময় তাঁকে স্মরণ রাখতে বাধ্য।
তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম একজন উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবক। তিনি পার্সোনাল কম্পিউটার বিপ্লবের পথিকৃৎ হিসেবেও স্বীকৃত। তিনি স্টিভ ওজনিয়াক এবং রোনাল্ড ওয়েন-এর সাথে একত্রিত হয়ে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে অ্যাপল কম্পিউটার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি অ্যাপল ইনকর্পোরেশনের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ও সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি পিক্সার এ্যানিমেশন স্টুডিওস-এরও প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ও সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৮৫ সালে অ্যাপল ইনকর্পোরেশনের বোর্ড অব ডিরেক্টর্সের সদস্যদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে তিনি অ্যাপল ইনকর্পোরেশনের থেকে পদত্যাগ করেছিলেন এবং নেক্সট কম্পিউটার প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৯৬ সালে অ্যাপল কম্পিউটার যখন নেক্সট কম্পিউটারকে কিনে নেয়, তখন তিনি অ্যাপলে আবার ফিরে আসেন। তিনি ১৯৯৫ সালে "টয় স্টোরি " নামের একটি অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্রও প্রযোজনা করেছেন। স্টিভ জবস ছিলেন কলেজ পালানো এক যুবক। তরুণ বয়সে মাদকও নিয়েছেন। ঘরছাড়া সন্ন্যাসী হবার ঝোঁকও ছিলো তার। তিনি ভারতবর্ষ ভ্রমণেও এসেছেন। কিন্তু সবকিছুতেই তার মধ্যে একঘেমেয়ি ছিলো। একথা স্টিভ নিজেই স্বীকার করেছেন। স্টিভের নিজের বক্তব্যেই ফুটে উঠেছে, ‘সফল স্টিভ জবস একঘেমেয়িতে তৈরী।'
স্টিভেন পল জবস ১৯৫৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। স্টিভ জবস, স্টিভ ওজনিয়াক এবং রোনাল্ড ওয়েন মিলে ১৯৭০ সালে অ্যাপল কম্পিউটার প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর তিনি পিক্সার স্টুডিও এবং নেক্সট নামে আরো দুটি সফল প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। জবস জন্মেছিলেন স্যান ফ্রান্সিস্কোতে। কিন্তু সুখকর ছিলো না তার ছোটোবেলা। জন্মের পরপরই তাকে দত্তক দিয়ে দেয়া হয়। পল ও ক্লারা জবস দম্পত্তি তাকে দত্তক নেন। তার নাম রাখা হয় স্টিভেন পল জবস। সামান্য ভালো খাবারের জন্য তাকে পুরো সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হতো।
কিন্তু তার প্রকৃত পিতা মাতা ছিলেন জোয়ন ক্যারোল এবং আব্দুল্লাহ ফাতাহ জান্দালি (সিরিয়া থেকে স্নাতোকোত্তর, পরবর্তীতে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক হয়েছিলেন)। ১৯৬১ জবস পরিবার ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেন ভিউ এলাকায় বসবাস শুরু করে। এ স্থানটিই পরে সিলিকন ভ্যালিতে রূপ নিয়েছে।
জবস কুপারটিনো জুনিয়র হাই স্কুলে এবং হোমস্টিড হাই স্কুলে গিয়েছিলেন। তিনি প্রায়ই হিউলেট-প্যাকার্ড কোম্পানিতে লেকচারগুলোতে অংশগ্রহণ করতেন। ১৯৬৮ জবস বর্তমান হিউলেট-প্যাকার্ডের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল হিউলেটের সঙ্গে কাজ শুরু করেন।
বিল হিউলেটের সঙ্গে স্পেয়ার পার্টস নিয়ে ফ্রিকোয়েন্সি কাউন্টার তৈরির কাজ শুরু করেন। হিউলেটের কেবল জবসকে পুরোনো যন্ত্রাংশই দেনননি এসময় তিনি এইচপিতে জবসের ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থাও করেন। ১৯৭০ এক বন্ধুর মাধ্যমে পরিচিত হন আরেক স্টিভ, অর্থাৎ স্টিভ ওজনিয়াকের সঙ্গে। যেখানে পরবর্তীতে তিনি গ্রীষ্মকালীন কর্মচারী হিসাবে তার সঙ্গে কাজ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি হাইস্কুল শেষ করেন এবং পোর্টল্যান্ডের রিড কলেজে ভর্তি হন। সে সময় রিড কলেজ ক্যালিগ্রাফি কোর্সগুলো করাতো। সুযোগে তিনি মূল কোর্স বাদ দিয়ে ক্যালিগ্রাফি পড়েন। এর ফলেই ডেস্কটপ কম্পিউটারে চমৎকার সব ফন্ট যোগ হয়।
১৯৭৪ সালে জবস ক্যালির্ফোনিয়াতে পুনরায় চলে আসেন। এ সময় তিনি নিয়মিত ওজনিয়াকের সাথে হোমব্রিউ কম্পিউটার ক্লাবের সভাগুলোতে উপস্থিত থাকেন। তিনি ভিডিও গেমস নির্মাতা প্রতিষ্ঠান "আটারি " তে টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি এসময় মূলত ভারতে যাবার জন্য অর্থ জমানোর চেষ্টা করছিলেন। জবস ভারতে নিম কারোলি বাবার কাইনিচি আশ্রমে তার বন্ধু ড্যানিয়েল কটকের সাথে ভ্রমন করেন। আধ্যত্মিক জ্ঞান অর্জনের জন্য তিনি ভারতে আসেন ও বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তরিত হন।
১৯৭৩ সালের শেষ দিকে ক্যালিফোর্নিয়ার লস গ্যাটোসে অ্যাটারি ইনকর্পোরেটেডে প্রকর্মী হিসেবে যোগ দেন জবস। ১৯৭৪ এর মাঝামাঝি সময় জবস ভারত ভ্রমণ করেন। নিম কারোলি বাবার সাথে সাক্ষাত্ করার জন্য জবস তার কৈঞ্চি আশ্রমে যান রিড কলেজের বন্ধু ড্যানিয়েল কোটকেকে সাথে নিয়ে। কিন্তু তা প্রায় জনশূন্য অবস্থায় ছিল, কারণ নিম কারোলি বাবা ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে মারা যান। এরপর তারা চলে যান হরিয়াখান বাবার আশ্রমে। ভারতে তারা কয়েকবার বাস ভ্রমণ করেন। দিল্লি থেকে উত্তর প্রদেশ, সেখান থেকে ফিরে হিমাচল প্রদেশ এরপর পুনরায় দিল্লি ফিরে আসেন। সাত মাস অবস্থানের পর জবস ভারত ত্যাগ করেন।
ভারত থেকে ফেরার পর জবসের নতুন আবির্ভাব ঘটে। তার মস্তক মুন্ডিত ছিল এবং তিনি ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় পোশাক পরিহিত অবস্থায় ছিলেন। এছাড়া তিনি বৌদ্ধধর্মের অনুসারি হয়ে ওঠেন। এরপর জবস অ্যাটারিতে ফিরে আসেন এবং আর্কেড ভিডিও গেম ব্রেকআউটের জন্য সার্কিট বোর্ড তৈরির কাজে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। প্রত্যেক চিপের জন্য $১০০ দেওয়ার প্রস্তাব দেয় অ্যাটারি। সার্কিট বোর্ড ডিজাইনে জবসের একটু বিশেষ জ্ঞান ছিল এবং তিনি ওজনিয়াকের সাথ সমানভাবে ফি ভাগ করে নেওয়ার চুক্তি করেন, যদি ওজনিয়াক চিপের সংখ্যা কমাতে পারেন।
অ্যাটারি ইঞ্জিনিয়ারদের বিস্মিত করে, ওজনিয়াক চিপের সংখ্যা ৫০-এ নামিয়ে আনেন। ডিজাইন এতটাই দূর্ভেদ্য ছিল যে অ্যাসেম্বলি লাইন নকল করা প্রায় অসম্ভব ছিল। ওজনিয়াকের কাছে থেকে জানা যায় যে অ্যাটারি তাদেরকে মাত্র $৭০০ দিয়েছিল (প্রস্তাবিত $৫,০০০ এর পরিবর্তে), এতে ওজনিয়াকের অংশ দাড়ায় $৩৫০। অবশ্য, ওজনিয়াক ১০ বছর পর আসল বোনাসের পরিমাণ জানতে পারেন। তবে তিনি বলেন যে,
"যদি জবস তাকে এ সম্পর্কে জানাত এবং তার টাকাগুলোর প্রযোজনীয়তা সম্পর্কে বলত তাহলে আমি তা তাকে দিয়ে দিতাম।"
টেলিফোন নেটওয়ার্ককে নিপূনভাবে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় টোন উত্পন্ন করতে, ওজনিয়াক একটি কম খরচের “ব্লু বক্স” তৈরি করেন। এতে দীর্ঘ দূরত্বের টেলিফোন কল বিনামূল্যে করা যেত। জবস সিদ্ধান্ত নেন যে তারা এটি বিক্রয় করে অর্থ উপার্জন করতে পারেন। এই অবৈধ ব্লু বক্সের চোরাগোপ্তা বানিজ্য ভালই চলে এবং এটি জবসের মনে বীজ বুনে দেয় যে ইলেকট্রনিক্স মজাদার এবং লাভজনক হতে পারে।