দিরিলিস আরতুরুল একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একদল নির্ভীক লড়াকু মানুষের ইনসাফ প্রতিষ্ঠার লড়াই। তারা নিজেদের পিঠ আর পেট বাচানোর জন্য বাচে না, তারা বাচে মর্যাদা, ইনসাফ আর ভালোবাসার জন্য। এই ভালোবাসার একাংশ দুনিয়ায় থাকা পরিবার-প্রিয়জনের প্রতি, বাকিটা আল্লাহর প্রতি।
নির্বোধ আইয়ুবী আমীর আল আযীয, নাইট টেম্পলার উস্তাদ ই আযম, মোঙ্গল নোইয়ান থেকে একেবারে নিজ গোত্রের কুচক্রী চাচা কুরদোলু, বড় ভাই গুন্দোদু বে, সবার সাথেই আরতুরুলকে লড়তে হয়। একেকজনের সাথে লড়াইয়ের চরিত্রটা একেকরকম, কিন্তু প্রত্যেকটা সংঘাতের একটা আদর্শিক কারন আছে। যেমন, আরতুরুলের সাথে তার বড় ভাই গুন্দোদুর বারবার বিবাদের মূল কারন, গুন্দোদু চায় নির্ঝঞ্ঝাট শান্তির জীবন কাটাতে। ওদিকে আরতুরুল মনে করে দুনিয়া শান্তির জায়গা নয়, দুনিয়া লড়াইয়ের জায়গা। এখানে মানুষ এসেছে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে। গুন্দোদু আসলে আমাদের চারপাশে থাকা শান্তিপ্রিয় মানুষের প্রতিচ্ছবি যারা সামান্য একটু সুখের আশায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইকে ছেড়ে দিতে চায়। আসলে কি তারা সুখে থাকতে পারে??
বিপরীতে আরতুরুল মনে করে, অন্যায়কে নির্মুল করে একটা ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক রাজ্য কায়েম না করা পর্যন্ত শান্তির আশা করা বৃথা। এরজন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু লড়াই করে যেতে হবে। এই লড়াইয়ে কৌশল ও শ্রম মানুষের, বিজয় আল্লাহর।
আরতুরুল তার এই লড়াইয়ে পাশে পায় তার আধ্যাত্মিক রাহবার শায়খুল আকবার খ্যাত মুহিউদ্দীন ইবনুল আরাবীকে। শায়খ বারবার বিভিন্ন তালিম দিয়ে এবং কারামাতের মাধ্যমে আরতুরুলকে সহযোগিতা করেন। শায়খ আরাবী একদিকে যেমন অসহায় মানুষের দিকে বাড়িয়ে দেন ভালোবাসার হাত, অন্যদিকে অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে যোগান শক্তি। আবার পরাজিত অন্যায়কারীর ওপর তিনি প্রতিশোধের বদলে ভালোবাসার অস্ত্র ব্যবহার করেন।
এভাবে ধীরে ধীরে দিরিলিসের কাহিনীতে যুক্ত হয় অসংখ্য বর্নিল চরিত্র।
হালিমা সুলতান আর হাইমে আনা চরিত্রদুটি রীতিমত অনন্য নারী চরিত্র। এই দুটো চরিত্রের ভেতর একই সাথে এমন রাষ্ট্রনৈতিক প্রজ্ঞা ও ন্যায়বোধের পাশাপাশি মাতৃসুলভ মমতা ও স্ত্রীসুলভ ভালোবাসার উপস্থিতি আমাদের বিমুগ্ধ করে তোলে।
এই অসামান্য চরিত্রগুলোর মাধ্যমে মেহমেদ বোজদাঘ ফুটিয়ে তুলেছেন এক অধুনাবিস্মৃত সভ্যতার গল্পকে। ইসলাম বলতে আধুনিক মুসলিম সমাজ বোঝে শুধু হালাল হারাম সংক্রান্ত কিছু অনুশাসন, কিন্তু ইসলাম যে হতে পারে মানুষের অন্তরের গহীনে থাকা জীবনীশক্তি, ইসলাম যে হতে পারে সমস্ত নিপীড়িত মানুষের আশ্রয় তা দিরিলিস আরতুরুল দেখে আমরা বুঝতে পারি।
দিরিলিস আরতুরুলে মূল ইতিহাসের বেশ কিছু খুটিনাটি পরিবর্তন করা হয়েছে, কিন্তু ইতিহাসের ভাবকে পরিবর্তন করা হয় নি যা মুহতেসিম ইয়ুজেঈলে করা হয়েছে। এটা দিরিলিসের একটি মুন্সিয়ানা।
সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের আলিমদের একাংশ বলছেন, এই সিরিয়ালটি দেখা হারাম। তারা পর্দা ও প্রেমের উপস্থাপনা সংক্রান্ত ইস্যু তুলে বলছেন এই সিরিয়ালটি দেখার চেয়ে না দেখাই ভাল।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, যারা এই কথাগুলো বলছেন, তারা আধুনিকতার ব্যাপকতা ও তা থেকে উদ্ভুত সমস্যার প্রকৃতি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিফহাল নন বলে আমি মনে করি। আমাদের আলিম সমাজ গোটা সমাজের সামগ্রিক বাস্তবতায় জনগোষ্ঠীর সর্বোচ্চ এক শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করেন। এই এক শতাংশটা গোটা সমাজ নয়।
আধুনিকতা আমাদের সামনে এক বিপুল সাংস্কৃতিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ আমাদের শিশুদের সামনে নিয়ে এসেছে ডিজনি, সিনডারেলা, টারজান, সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান, ডোরেমন এমনকি রামায়ন ও মহাভারতের মত কার্টুন।
একটু বড় হলেই আমাদের হাতের কাছে এসে উপস্থিত হয় টু এন্ড হাফ মেন, ফ্রেন্ডস, বিগ ব্যাং থিওরি, ফ্যামিলি গাই। অধুনা গেইম অফ থ্রোন্স সহ এইচবিও-নেটফ্লিক্সের প্রোডাকশনগুলির কথা তো সবার মুখে মুখে।
যারা দিরিলিস আরতুরুল দেখা বন্ধ করতে চান, তারা কি এগুলি দেখা বন্ধ করতে পারবেন??
দিরিলিস আরতুরুল, পায়িতাহত আব্দুল হামিদ, মেহমেতচিক কুত উল আমরে, কুরুলুস ওসমান সহ এই ধারার তুর্কী সিরিয়ালগুলো আধুনিক তরুণদের মনে যে ঝড় তুলেছে তাকে আপনারা নেতিবাচকভাবে দেখতে পারেন বটে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে তাকে নেতিবাচক বলার সুযোগ নাই।
যে মানুষটা আগে কোনদিন কোন টিভি সিরিজই দেখে নাই তাকে আপনি বলতে পারেন তুমি দিরিলিস দেখো না, এটা হারাম।
যে দুপুর ঠাকুরপো আর গেইম অফ থ্রোন্স দেখা বাদ দিয়ে, অথবা স্টার জলসা-জি বাংলা বাদ দিয়ে দিরিলিস বা পায়িতাহত দেখে, তাকে যদি আপনি বলেন দিরিলিস দেখা হারাম, এর ফলটা কি হতে পারে???
বিশ্বায়িত সংস্কৃতির যুগে আদর্শিক লড়াই অনেকখানিই মনস্তাত্ত্বিক। জনমানস নির্মানের জন্য বয়ান তৈরির যে কাজ, তার স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী ধরন আছে।
ভিজ্যুয়াল-অডিটরি মেমরির মাধ্যমে জনমত উৎপাদন তথা কনসেন্ট ম্যানুফ্যাকচার করার যে প্রক্রিয়া, সেখানে সংবাদ, ডকুমেন্টারি, টক শো, রিয়ালিটি শো, নাটক, সিরিয়াল, সিনেমা, গানের ভুমিকাই প্রধান। মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে জনমত উৎপাদনে এই কাজ করতে পারে বই। একাডেমিক ও নন একাডেমিক, ফিকশন ও নন ফিকশন এবং ক্রিয়েটিভ নন ফিকশন সহ বিভিন্ন জনরার বই দীর্ঘমেয়াদে জনমত উৎপাদন করে।
তাই সংবাদ, ডকুমেন্টারি, টক শো, রিয়ালিটি শো, গান, নাটক, সিরিয়াল ও সিনেমাকে আপনি ছেড়ে দিলে আপনার পরের প্রজন্মের মগজের জমিন আপনার শত্রুদের হালচাষের ক্ষেতে পরিনত হবে।
তার মানে এই না, হলিউড বলিউড যা করছে, যেভাবে করছে আমরাও তাই করবো। আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করার একটা সামগ্রিক নীতিমালা অবশ্যই থাকা উচিত। সেটা জনগনকে বোঝানোর চেয়ে নির্মাতাদের বোঝানোটা জরুরী।
তা না করে যারা হারাম হারাম রব তুলছেন, একবিংশ শতাব্দীতে নিজ ঘরানার বাইরের মুসলমানদের সম্পর্কে তাদের উপলব্ধির দশা রীতিমত আশঙ্কাজনক।
বিঃ দ্রঃ
আমি কোথাও একে ইসলামিক সিরিয়াল বলি নাই। এটা ইসলামের ইতিহাসনির্ভর সিরিয়াল। সিরিয়াল-উপন্যাসে বাস্তব সত্য মাঝে মাঝে শিল্পসত্যের আড়ালে চলে যায়, তবে যতক্ষণ মূলভাব ঠিক থাকে, তা সামগ্রিকভাবে কল্যান নিয়ে আসার ক্ষমতা রাখে।
ভাবগত দিক থেকে এই নির্মান সম্পুর্ন ভিন্ন।
আলিমদের জায়গা থেকে একে হারাম বলা ছাড়া গতি থাকে না। কিন্তু একে হারাম করার আগে আলিমদের করার আরো অনেক কিছু আছে। এর চেয়ে বড় হারাম যদি আলিমরা বন্ধ না করতে পারেন তবে এই হারামের পেছনে লাগার মধ্য দিয়ে শত্রুর এজেন্ডাই বাস্তবায়িত হবে। মিসর-সউদীতে তাই হচ্ছে।
সিরিয়াল দেখে ইতিহাসের সন তারিখ কেউ শেখে না, শিখতে চায় মূলভাব। বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত মূলভাব ঠিক আছে কি না।
আমরা শতকরা কত শতাংশ ছেলেমেয়েকে রাতারাতি ইসলামী ইতিহাসের বই দিয়ে বসিয়ে দিতে পারবো?? সেই সাহিত্য কি আমরা তৈরি করতে পেরেছি?? অনেকে তো এতদুর বলেন যে ইসলামী সাহিত্য হিসেবে যেসব ঐতিহাসিক উপন্যাস হয় তাও হারাম।
জনসাধারনের জন্য ইতিহাসের চেয়ে ঐতিহাসিক উপন্যাস-থ্রিলার-ছবি ও সিরিয়ালই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরা হয়, কারন পুঙখানুপুঙখ বিবরনের চেয়ে জনসাধারন চায় আসলে কি ঘটেছিল তার সারবস্তু জানতে।
জনগনের জন্য এধরনের সিরিয়ালের কোন বিকল্প এখন নাই। কালচারে শুন্যস্থান বলে কিছু থাকে না। হারাম বলার আগে শুন্যস্থান পুরন করে এরপর হারাম বলার অনুরোধ রইলো।