গত দুইমাস ধরে পেঁয়াজের দাম তুঙ্গে। এর কোনো সুরাহা হচ্ছে না। সরকারের সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হচ্ছে। বাংলাদেশ একজন ব্যক্তির দেশ। প্রধানমন্ত্রী ছাড়া বাকীসব মন্ত্রী-আমলা শো-পিচ। এরা ছোটো কিংবা বড় কোনো সমস্যাই সমাধান করতে পারে না। যিনি সমাধান করতে পারেন তিনিও বলেছেন পেঁয়াজ ছাড়া তরকারির রেসিপির কথা। তিনি এই সমস্যা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করেছেন সংবাদ সম্মেলনে। তাই মজুদদাররা আরো সুযোগ পেয়েছে। অবশ্য সব মজুদদাররাই হাসিনার পকেটের লোক।
রাজধানীর খুচরা বাজারে ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে। পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের কোনও উদ্যোগই এবার কাজে আসেনি। বাজার অস্থির হওয়ার শুরুতেই টিসিবিকে দিয়ে খোলা বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি এবং তুরস্ক, মিসর, মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু এসব উদ্যোগ কোনও সুফল দেয়নি।
সরকারের কোনও উদ্যোগই এবার পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি রোধ করতে পারেনি। ৪০ টাকা কেজি দরের পেঁয়াজ ১৫৫ টাকা দরে বিক্রি হওয়ার আগেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় টিসিবিকে (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে। টিসিবি ৪৫ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি করলেও বাজারে তা কোনও প্রভাব ফেলেনি। উল্টো দাম বেড়েছে হু হু করে। কয়েক ধাপে ৪০ টাকা কেজি দরের পেঁয়াজ ৮০ টাকা, ১০০ টাকা, ১১০ টাকা, ১১৫ থেকে ১২০ টাকা, ১৩০ টাকায় পৌঁছে যায়। আর দুদিন আগে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ একলাফে ১৫০-১৬০ টাকা দরে বিক্রি হয়।
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তুরস্ক, মিয়ানমার ও মিসর থেকে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নিলেও আমদানিকারকদের মধ্যে এর ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। মিয়ানমার থেকে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা কিছু পেঁয়াজ আমদানি করেছেন। কিন্তু তাতেও পেঁয়াজের দাম কমেনি। জানা গেছে, সময় ও পরিবহন খরচের কথা চিন্তা করে শুরুতে আমদানিকারকরা মিসর ও তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আমদানি করেননি। পরে মেঘনা, সিটি ও এস আলম গ্রুপকে দিয়ে সরকার তুরস্ক ও মিসর থেকে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নিলেও সেই পেঁয়াজ এখনও পর্যন্ত দেশে এসে পৌঁছায়নি।
বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধি ও দেশীয় জোগান কম থাকায় নয়, কারসাজি করেই পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হয়েছে। কখনও কখনও আমদানি মূল্যের দ্বিগুণ দামে ভোক্তারা পেঁয়াজ কিনতে বাধ্য হয়েছেন। কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী একশ্রেণির ব্যবসায়ী পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মজুদও গড়ে তোলেন। মাঝখানে কয়েকটি স্তরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। আর তাদের সহযোগিতা করছে সরকার ও প্রশাসন। জনগণকে জিম্মি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে মজুদদার, আমদানিকারক, সরকার ও প্রশাসন চক্র।
দেশের চারটি বন্দরের মাধ্যমে পেঁয়াজ আমদানির রেকর্ড ও দাম পর্যালোচনা করা হয়েছে। কেন আমদানি মূল্যের সঙ্গে খুচরা বাজারে দামের বিশাল ফারাক- এ ব্যাপারে যৌক্তিক কোনো ব্যাখ্যা নেই কারো কাছে। সমকালের রিপোর্ট থেকে জানতে পারলাম, জুলাইয়ে ভারত থেকে আনা বেশিরভাগ চালানের প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম পড়েছে ১০ থেকে ১৩ টাকা। আগস্টে আমদানি করা প্রতি কেজির সর্বনিম্ন দাম পড়ে ১১ টাকা। ওই মাসে কিছু চালানের প্রতি কেজি পেঁয়াজের সর্বোচ্চ দাম পড়ে ৩৯ টাকা। তবে আগস্টে আসা অধিকাংশ চালানের প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম পড়ে ১২ টাকা। সেপ্টেম্বরে ভারত থেকে আসা প্রতি কেজি পেঁয়াজের গড় মূল্য ছিল ১২ থেকে ২৫ টাকার ভেতরে। তবে ওই মাসে বেশিরভাগ চালানের প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ২২ ও ২৫ টাকা। গত অক্টোবরে ভারত থেকে কেনা প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম পড়ে ২০ থেকে ৩৩ টাকার ভেতরে। তবে বেশিরভাগ পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজিতে ছিল ২৫ টাকা। নভেম্বরে এসে প্রতি কেজি পেঁয়াজের গড় দাম ছিল ২৫ থেকে ৪১ টাকা। তবে ২৫ নভেম্বরের পর কিছু চালানের পেঁয়াজের দাম পড়ে প্রতি কেজি ৭১ টাকা।
বন্দরে পেঁয়াজের চালান আসার পর সরকারি কিছু খরচসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় বাবদ প্রতি কেজিতে আরও এক টাকা খরচ হয় আমদানিকারদের। এ ছাড়া এসব পেঁয়াজ বন্দর থেকে রাজধানী পর্যন্ত আসতে কেজিপ্রতি আরও এক থেকে দেড় টাকা খরচ হয়ে থাকে। এর পর আমদানিকারকরা পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে এসব পেঁয়াজ বিক্রি করেন। পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে। সব মিলিয়ে ভারত থেকে আমদানি করার পর তিন-চার হাত হয়ে পেঁয়াজ ভোক্তার কাছে পৌঁছে।
বাজারে এখন পেঁয়াজের যা দাম তা কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য নয়। এখন পর্যন্ত যত পেঁয়াজের আমদানি হয়েছে তাতে এই অগ্নিমূল্য হওয়ার কথা নয়। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা সহ সিন্ডিকেট ভোক্তাদের পকেট কাটছেন। সব খরচসহ প্রতি কেজি পেঁয়াজে দুই টাকা করে লাভ করার লক্ষ্য থাকে তাদের। এ হিসাবে গত বছরের জুলাইয়ে ভারত থেকে আমদানি করা পেঁয়াজের দাম হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ১৬ থেকে ১৮ টাকা। আগস্টে দাম হওয়ার কথা ছিল ১৭-১৮ টাকা। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ২৫-২৬ টাকা। সেপ্টেম্বরে ৩০-৩২ টাকা, অক্টোবরে ৩০-৩২ টাকা। ২৫ অক্টোবরের পর থেকে কিছু ক্ষেত্রে দাম হওয়ার কথা প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ৮০ টাকার মতো। কিন্তু আমরা পেঁয়াজ কিনছি ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা।
বছরে দেশের চাহিদার সিংহভাগ পেঁয়াজ স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হচ্ছে। বছরে ১৭-১৯ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। বাকি চাহিদা আমদানিতে মিটছে। আমদানির প্রধান বাজার ভারত থেকে অধিকাংশ পেঁয়াজ আসে। গত বছরে ৭ থেকে ১১ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়। এ হিসাবে দেশে পেঁয়াজের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকার কোনো সুযোগ নেই। তবে প্রায়ই পেঁয়াজের সরবরাহ ঘাটতির কথা বলে হঠাৎ দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সরকার শুধু এতে ব্যর্থ নয়, আমি বলবো সরকার জনগণের পকেট কাটায় জড়িত।